শীতের এক রাতে। একজন ইঞ্জিন ভ্যান চালক তার গাড়িটা হাটবাজারের একেবারে প্রবেশপথের সামনের একটা কোণে দাঁড় করিয়ে চাদর গায়ে দিয়ে..একটা দোকানঘরের সামনে তিনি ও তার হেল্পার শুয়ে আছে। ভোর তিনটে থেকে এক এক করে লরি আসতে থাকবে হাটে..তখন থেকেই তার ডিউটি শুরু আর কি। ভ্যানে কাঁচামাল বোঝাই করে তিনি ও তার হেল্পার সেখান থেকে অনেক দুরে মানে তাদের লোকালয়ের সবথেকে জনবহুল এরিয়ার এক বাজারে নিয়ে আসবে। ওখানেই তিনি এবং তার বউ সবজী বিক্রি করে।
এটাই তাদের রোজকার রুজিরোজগারের একমাত্র মাধ্যম। আর এই ভ্যানটা তাদের রোজকার নিত্যসঙ্গী।
তো যেইদিনকার কথা বলছি..তিনি ও তার হেল্পার তখন শুয়ে আছে। হঠাৎ একটা মাঝবয়সী ভদ্রলোক এসে একটা চিৎকার করে তাদের ডেকে উঠলো..
বড়োভাই..
বড়োভাই..
চিৎকার শুনে ইঞ্জিন ভ্যান চালক ও হেল্পার দুইজনেই উঠে বসলো..
তো ওই লোকটাকে দেখে ইঞ্জিন ভ্যান চালক বললো কি হয়েছে? এতোরাতে আপনি এইভাবে ডাকছেন কেন?
তখন ওই মাঝবয়েসী ভদ্রলোকটি বলে উঠলো..
বড়োভাই..তাড়াতাড়ি চলুন। আমার ছেলের খুব শরীর খারাপ..ওকে হাসপাতালে না নিয়ে যেতে পারলে ওহ হয়তো বাঁচবেনা। তাড়াতাড়ি চলুন বড়োভাই। বেশী দূর নয় সামনের এক দোকানে ওকে বসিয়ে রেখে এসেছি।
ইঞ্জিন ভ্যান চালক নিজের টাইপ সেট বের করে দেখলো ঘড়িতে তখন রাত ১.০০ টা। ওই সময় দেখার জন্য আর কয়েকজনের সাথে কথাবলার জন্য লোকটি ফোনটা কিনেছিলো..আসলে কিনেছিলো বললে ভুল হবে..তার বউ জোড় করে কিনতে বাধ্য করেছিলো। তাদের কাছ থেকে সবজী কিনতো এক তান্ত্রিক এই ফোনটা বিক্রি করেছে তাদের কাছে। তান্ত্রিকটা প্রচুর মদ খেতো। সংসারের চাপে, পারিবারিক ধমকে সে মদ খাওয়ার পথ থেকে সরে আসতে চাইছিলো..বলাবাহুল্য সে এই প্রচেষ্টা আগেও অনেক বার করেছে তবে তার প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে।
এইবার তার পরিবার এমন চাপে রেখেছিলো যে তিনি বাধ্য হয়ে মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন..কিন্তু তিনি মদ ছাড়লেও মদ যে তাকে ছাড়েনি। প্রায় একমাস তিনি মদ খায়নি। স্মৃতির গোড়ায় জল দিলে দেখা যায়যে..লোকটা যেপরিমাণ অর্থ উপার্জন করতো সেই টাকা তার বউ নিজের হাতে নিয়ে নিত। তার স্বামীর হাতে দিতোনা। যাতে তার স্বামী বিফলে না চলে যায়। দেশীমদের দোকানে গিয়ে তান্ত্রিকের বউ শাসিয়ে এসেছিলো যাতে তার স্বামীকে এই দোকানের আসেপাশে দেখলেই যেন পিটিয়ে ভাগিয়ে দেয়।
তো লোকটা একটা মাস অনেক যন্ত্রনায় কাটিয়েছে..মদ ছাড়ার পর থেকে তার রাত হলেই কোমড়ে ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা। অথচ যেকটাদিন মদ খেত সেইকটা দিন তার শরীরে কোনো ব্যথ্যাই ছিলোনা।
তো ওই তান্ত্রিকটি মাত্র ১০০ টাকাতে এই ফোনটি দিয়ে দেয় ওই সবজী বিক্রেতার কাছে। কমদামে ফোন পেয়ে তারা বেজায় খুশী। তবে তান্ত্রিকটি একটা নির্দেশ দিয়েছিলো তাদেরকে..যে..
এই ফোনে একটা নম্বরে ফোন আসে ২২২ এই তিনটে নম্বরে। এই নম্বরে ফোন এলে যেন তিনি সেই ফোনটি না ধরে। কারণ এই নম্বরে যখনি ফোন আসে তখনি কোনো না কোনো অঘটন ঘটে। এইবলে তান্ত্রিকটি পয়সা নিয়ে ফোনটি তাদের দিয়ে বাজার থেকে চলে যায়। তবে ওই যে নম্বর থেকে ফোন আসতো সেই নম্বরে আসা ফোন ধরলে যে কি পরিণতি হতে পারে সেইবিষয়ে ওই তান্ত্রিকের জানা নেই। কারণ তিনি নিজেও ওই নম্বর থেকে আসা ফোন কোনোদিনও ধরেননি।
মোবাইলে সময় দেখাটা ওই লোকটির পাড়ার এক মাস্টারমশাই শিখিয়েছিলেন..
কাজেই তিনি সময়টা বুঝতে পারতেন। ওই ইঞ্জিনভ্যান চালক বললো - চলুন..তবে আমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন..ভোর বেলায় গাড়ি ঢুকবে। মাল নিতে হবে। আর ভাড়া ১৫০/- টাকা নেবো।
ওই মাঝবয়েসী ভদ্রলোকটি বললো ঠিক আছে ভাই আগে তো চলুন আমার ছেলেকে বাঁচান বড়োভাই।
তো ওই ইঞ্জিন ভ্যান চালক মাংকি টুপি পড়ে, চাদর-টা গায়ে জড়িয়ে..ভ্যানের ইঞ্জিনটা চালু করে যেই ভ্যানটা চালানো শুরু করবে ওমনি তার ফোন বেজে উঠলো..
লোকটি ফোন ধরে বললো - হ্যালো কে?
ওপাশ থেকে কেউ কোনো কথা বলছেনা। তিনচারবার হ্যালো হ্যালো করে..শেষে বিরক্ত হয়ে তিনি যখন ফোনটা কেটে দেয়। তবে কেটে দেওয়ার আগে তিনি একটা অদ্ভুত জিনিস আবিস্কার করে যে..মাত্র তিনটে নম্বরে ফোন এসেছিলো। এর আগে কখনো এই নম্বরে ফোন আসেনি। লোকটির তখন তান্ত্রিকের কথা মাথায় নেই। এদিকে গ্রামের মানুষদের মনে এতো প্যাঁচ থাকেনা। এখান থেকে হসপিটাল অনেক দুরে। আর যাতায়াত ব্যবস্থা সেমন ভালো নয়। ভ্যানচালক কম করেই ভাড়া বলেছে। তিনি যেহেতু খেটে খায় তাই আরেকজন খেটে খাওয়া মানুষের দুঃখ-টা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারে।
লোকটি ভ্যান চালাতে চালাতে ভাবছে..ইশ আজ যদি গাড়ি আগে ঢুকে যায় তাহলে তিনি মাল নিতে পারবেন না আর। কারণ এ ওহ সব দরদাম করে যে যা পারবে কিনে নিয়ে চলে যাবে। আর লোকটির বাঁধাধরা দুই জায়গা আছে..তিনি বারোমাস ওই দুই জায়গা থেকেই তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেয়।
লোকটি মনে মনে ভাবছে ইশ, আজ যদি..সময়ের একটু হলেও উনিশ বিশ হয় তবে তার আর কেনা-বেচাটা ঠিকঠাক হবেনা। তার বাজেট ছিলো ১২০০ টাকা৷ যদি সময় মতোন আসতে না পারে তাহলে তার হাত থেকে অনেক গুলো টাকা খসতে পারে। কারণ তিনি যেই জায়গা দুটো থেকে কাঁচামাল কেনেন সেই জায়গা দুটো হাঁটের একেবারে সামনেই.. মানে হাঁটে ঢুকতেই আগে ওই জায়গা গুলো পড়ে আরকি। তাই জিনিসপত্র বিক্রি হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। সকাল ১০.০০টার পর থেকে হাঁট ভেঙে যায় তখন থেকে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বাড়ে।
তো এই সেই চিন্তা করতে করতে ভ্যান চালাচ্ছে। তো হঠাৎ করে ওই লোকটা বললো বাবু ওইযে ওই দোকানের সামনে গাড়ি দ্বার করান।
লোকটির কথামতোন ওই ইঞ্জিনভ্যান চালকটি তার ভ্যান দ্বার করায়। দেখে যে একটা ছেলে হেলান দেওয়ালে দিয়ে বসে আছে..তার গায়ে রয়েছে একটা নোংরা সোয়েটার। ইঞ্জিন ভ্যান চালক ও তার হেল্পার দুইজনে মিলে ছেলেটাকে ভ্যানে তুললো। তারপর হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হলো। যেতে যেতে আবারো ইঞ্জিন ভ্যান চালকটি ভাবনার রাজ্যে চলে গেলো..
সে ভাবতে লাগলো মানুষ এই ভালো এই খারাপ। গ্রামের মানুষরাই বেশী কষ্ট করে..শহরের মানুষেরা কতবেলা অবধি পড়েপড়ে ঘুমোয়। এই সাতপাঁচ ভাবছে হঠাৎ তারমনে হলো ভ্যানটা কেমন আগের থেকে ভারী-ভারী লাগছে।
চারজন মানুষের যা ওজন হয় তার থেকেও বেশী ওজনের মনে হচ্ছে ভ্যানটি। আর সবথেকে বড়োকথা পেছন থেকে একটা মরা পচার তীব্র গন্ধ আসছিলো..যাকিনা সত্যিই অস্বস্তিকর।
তো ওই চালক তখন একটা ছোটো ব্রীজের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো নিচে একটা জলশয়। বেশী দুরত্ব নয়। মানে ব্রীজথেকে জলাশয়ের দুরত্ব চারহাত হবে। তো চালকের তখন কি মনে হলো সে পেছনে তাকালো..পেছনে তাকিয়ে দেখে যে..ছয়জন লোক ও সেই ছেলেটি আর তার বাবা তারা সকলে মিলে ওই হেল্পারটির দেহটিকে হিংস্র জন্তুর মতোন খাচ্ছে। চালক তখন মারাত্মক রকম একটা ঝটকা খেলেন..তিনি ভ্যানের ব্রেক কষতে চাইছিলেন কিন্তু ভ্যান আর দাঁড়ায়না। তাই তিনি কি করবে কি করবে ভেবে না পেয়ে ওই জলাশয়ে ঝাঁপ দেন।
উনি অজ্ঞান হবে হবে করছেন কিন্তু তখন ওনার এইরকম একটা অবস্থা যে ওনার অজ্ঞান হওয়ার মতোন সেই পরিস্থিতি তৈরী হয়নি। আর তার থেকে বড়ো কথা উনি বিশাল খাটতে পারে। উনি এতো সহজে ভেঙে পড়েন না। তবে এই বিষয়টিকে তিনি কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। তিনি একে তো এই ঠান্ডার মধ্যে কল সাঁতরে সাঁতরে কোনো রকম ভাবে ডাঙায় উঠলেন..তিনি কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ছুটতে লাগলেন। তার বুক বিশাল ধড়ফড় করছিলো..দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একসময় উনার চোখ দুটো বুজে এলো..তবে চোখ বন্ধ করবার আগে উনি বাজারের কথা চিন্তা করছিলেন। এমন সময় তার একটা ফোন আসে..ওই ফোনটা পকেট থেকে বের করার সাথে সাথে তিনি অজ্ঞান হয়ে যায়।
অজ্ঞান হওয়ারই কথা। তিনি আর নিতে পারছিলেন না। সকালে যখন তার ঘুম ভাঙে সে দেখে বাজারে একটা মাচার মধ্যে। এই মাচায় সন্ধ্যাবেলায় সকলে বসে আড্ডা দেয়। তো ওই ইঞ্জিন ভ্যান চালকটির যখন ঘুম থেকে উঠেই সে তার হেল্পারকে আগে দেখতে পেলো। এছাড়া তার বড় ছেলে, এক চায়ের দোকানের দাদা সবাই রয়েছে।
তো তিনি যখন আস্তে আস্তে উঠে বসলেন তখন তার ছেলে জিজ্ঞেস করে তার কি হয়েছিলো??
তিনি ধীরেধীরে নিশ্বাস নেয়। আর সব বলতে থাকে।
সবশুনে তার হেল্পার তো পুরোই অবাক। আর হেল্পারের কথা শুনে ওই ইঞ্জিন ভ্যান চালকটি আরও অবাক হয়ে যায়।
ওই হেল্পার যা বললো।
তিনি আর ওই ইঞ্জিন ভ্যান চালকটি পাশেই শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ রাত ১.০০ টার দিকে তার মালিক স্বপ্নের মধ্যে কি উল্টোপাল্টা বলতে থাকে..তো একসময় সে ঘুমের মধ্যেই বকবক করতে করতে উঠেবসে তারপর সে পাগলের মতোন হাত দুটো সামনে নিয়ে দৌঁড়াতে থাকে। মানে দুর থেকে দেখলে মনে হবে যে, ছোটো বাচ্চারা যেভাবে বাইক চালায়..মানে হাত দুটো উঁচু করে। সেইভাবে তিনিও হাত দুটো উঁচু করে এক দৌঁড় দিতে লাগলেন। তো এই দেখে তার হেল্পার ও চেঁচামেচি করতে করতে তার পেছনে দৌঁড় দেয়। শেষে তিনি একটা জলাশয়ের পাশে গিয়ে ওই ইঞ্জিন ভ্যান চালকটিকে উদ্ধার করেন।
সবশুনে ইঞ্জিন ভ্যান চালকটি খুব অবাক হয়ে যায়। মানে কি হচ্ছিলো, ভোর রাতে তার সাথে কি হয়ে গেলো..সেইসব ভাবলেই তার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠছে।
তবে চমক এখনো বাকি ছিলো। ওই হেল্পার আর ইঞ্জিন ভ্যান চালকের বড়ো ছেলে ওখন ভ্যান চালকটিকে ধরে ধরে ভ্যানের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলো চালকটির চোখ গেলো এক জায়গায় প্রচুর লোক জড়ো হয়ে আছে সেইদিকে।
জায়গা হলো সেই জায়গা যেখানে তারা গতরাতে শুয়েছিলো। ওই ইঞ্জিন ভ্যান চালক বললো - ওখানে এতো ভীড় কেন? কি হয়েছে??
হেল্পার টি তখন বললো - বাবু..কাল রাতে তো আপনি ওইভাবে বকবক করতে দৌঁড় দিলেন..আপনার পেছন পেছন আমিও দৌঁড় দিলাম। যখন আপনাকে পেলাম তখন..অনেক খুঁজে দুইজনকে খুঁজে পেয়ে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আপনাকে ধরে ধরে যখন বাজারের মাচাতে নিয়ে এলাম তখন এসে দেখি যেখানে আমরা শুয়েছিলাম সেইজায়গা তো রাস্তার ধারেই..তো ওখানে একটা লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওই দোকানঘরে গিয়ে ধাক্কা মারে।
ভাগ্যিস আপনি দৌঁড় দিয়েছিলেন আর আপনার পেছন পেছন আমিও দৌঁড় দিয়েছিলাম নাহলে দুইজনের যে কি হতো বলা যেত না।